Thursday, 1 December 2016

প্রথম দর্শনেই প্রেম

“পুষ্পে পুষ্পে ভরা শাখী, কুঞ্জে কুঞ্জে গাহে পাখি, গুঞ্জরিয়া আসে অলি কুঞ্জে কুঞ্জে ধেয়ে তারা ফুলের ওপর ঘুমিয়ে পড়ে ফুলের মধু খেয়ে।’ দ্বিজেন্দ্র লাল রায়ের কবিতার এ চরণগুলো মনে হলে কার না ইচ্ছে হয় ফুলের বাগান করার। কিন্তু ঢাকা মহানগরীতে কী আর এখন ফুলের বাগান করা সম্ভব। জায়গার যে বড়ই অভাব। হয়তো তখন অনেকের স্মৃতিতে ভেসে ওঠবে শৈশবের কথা। মফস্বল শহর ১০ থেকে ১৫ কাঠা জায়গার মাঝখানে একতলা টিনের ঘর নয়তো একতলা দালান। এরই সম্মুখে ফুলের বাগান। এমনি জায়গা থাকলে আপনিও করতে পারেন ফুলের বাগান, শুধু তাই না বাড়ির ছাদেও করা যাবে নানান রকমের ফুলের চাষ। জুঁই, চামেলী, রজনীগন্ধা, গোলাপ, কামিনী, জবা, বেলী, কেতকী কত না ফুলের গাছ। যিনি একটু সৌখিন তিনি এখনো মফস্বল শহরে বাড়ির সামনে নয়তো নগরীতে নিজ বাসার সামনে অথবা ছাদে টবে দু’চারটি গোলাপ, ২টি কামিনী, ১টি বেলী, ১ টি রজনীগন্ধা কিংবা অন্যান্য পছন্দের ফুলের গাছ লাগান।

ফুলের প্রতি কোনোরূপ আকর্ষণ নেই, ধারণা করি পৃথিবীতে এমন রুক্ষ-শুষ্ক মানুষ খুব কমই আছে। বরং নেই বললেই চলে। চার বছরের শিশু থেকে ৭০ বছরের বৃদ্ধ, কমবেশি সবার মধ্যেই ফুলের প্রতি আকর্ষণ আছে। ফুলের সৌন্দর্য আর সৌরভের কাছে পরাস্ত হয়নি, এমন মানুষ পৃথিবীতে বিরল।
ফুল সৌন্দর্যের প্রতীক। মানুষের সৌন্দর্যপ্রেম সহজাত। সহজাত সৌন্দর্যপ্রেম থেকেই সৌন্দর্যের প্রতীক ফুলের প্রতি মানুষের আকর্ষণ। এর পাপড়ির বিন্যাস, রঙের বৈচিত্র্য ও গন্ধের মাধুর্য মানুষের মনকে ভরে তোলে স্বর্গীয় আনন্দে। ফুল পবিত্রতার প্রতীক। ফুল নিষ্পাপতার প্রতীক। কোনো মানুষের পবিত্রতা বোঝানোর জন্য আমরা বলি, ‘ফুলের মতো পবিত্র।’ শিশুকে আমরা ভালো মানুষ হতে ও নিষ্পাপ-নিষ্কলঙ্ক হতে উদ্বুদ্ধ করতে গিয়ে বলি, ‘ফুলের মতো পবিত্র হও।’ শিশু নিষ্পাপ, পবিত্র। তাই শিশুকে ফুলের সঙ্গে উপমা দেয়া হয়। বলা হয়- পুষ্পশিশু।
ফুল ভালোবাসার প্রতীক।
ভালোবাসার মানুষকে ফুল দেয়ার রীতি পৃথিবীতে দীর্ঘকাল থেকে চলে আসছে। বলা হয়ে থাকে, ১৮৪০ সালে ইংল্যান্ডের রানী ভিক্টোরিয়ার বিয়ের সময় প্রিয় মানুষকে ফুল দেয়ার রীতি প্রথম চালু হয়। সে হিসেবে ভালোবাসাবাসিতে ফুলচর্চার বয়স পৌনে ২০০ বছর।

মানব-সংস্কৃতির পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে ফুল। বাঙালির জীবনাচারেও ফুলের ব্যবহার বহুবিধ। ভালোবাসার অর্ঘ্য হোক অথবা ধর্মালোচনার মজমা- ফুল আছে সর্বত্রই। অবোধ বালিকার বেণীতে, নবদম্পতির ফুলশয্যায়, রাজনৈতিক দলের জনসভায়, করপোরেট অফিসের টেবিলে- ফুল আছে সবখানেই।
কবিতায় ফুল

কবিতা লিখেছেন, কিন্তু ফুল নিয়ে কবিতা লিখেননি, ফুল দিয়ে উপমা দেননি, এমনটা বিরল। সব কবিই কমবেশি ফুল নিয়ে কবিতা লিখেছেন, উপমায় ফুলের ব্যবহার করেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এ পর্যন্ত ফুল নিয়ে কবিরা কত শত-সহস্র কবিতা লিখেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। বাংলাভাষার জনপ্রিয় কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন-
‘জোটে যদি মোটে একটি পয়সা
খাদ্য কিনিয়ো ক্ষুধার লাগি’
দুটি যদি জোটে অর্ধেকে তার
ফুল কিনে নিয়ো, হে অনুরাগী!
বাজারে বিকায় ফল ত-ুল
সে শুধু মিটায় দেহের ক্ষুধা,
হৃদয়-প্রাণের ক্ষুধা নাশে ফুল
দুনিয়ার মাঝে সেই তো সুধা!’
প্রচলিত আছে, কবিতাটি নাকি কোনো এক হাদিসের অনুবাদ। প্রচলিত কথাটি ভুল। এ মর্মে কোনো হাদিস আছে বলে আমাদের জানা নেই।
কবি জসীমউদ্দীন ‘হলুদ বরণী’ কবিতায় লিখেছেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত’ কবিতাংশটুকু প্রবাদে পরিণত হয়েছে। কবি আল মাহমুদ ফুল নিয়ে অনেক কবিতা লিখেছেন। তার কবিতাগুলো থেকে একটি উদাহরণ,
‘দীঘির কথায় উঠলো হেসে ফুলপাখিরা সব
কাব্য হবে কাব্য হবে জুড়লো কলরব
কী আর করি পকেট থেকে খুলে ছড়ার বই
পাখির কাছে ফুলের কাছে মনের কথা কই।’
ফুল নিয়ে রচিত এ ধরনের হাজারও উদাহরণ দিতে চাইলেও দেয়া সম্ভব।
আজ দেশে ফুল বাগানের বড় অভাব।একদা ফুল বাগানে বেড়ায়ে ফুলের সুবাস নিতো বাঙালিরা। যে জন্য আজ ফুলের বাগান গড়ে উঠতে পারে দেশের প্রতিটি শহরের নদী তীরবর্তী এলাকায়। থাকবে সেখানে বকুল, চামেলী, গোলাপ, পলাশ, শাপলা, শিউলি, কৃষ্ণচূড়া, শেফালীর ছড়াছড়ি। প্রেমিক যিনি তার তো ইচ্ছে জাগবে বকুল তলে বসে প্রিয়তমার হাতে হাত রেখে- “এই বকুলের বনের ছায়ায় জানি বন্ধু চিনবে দেখে/ মোর চিতারি চিহ্ন রেখায় এই মিনতি দিনের শেষে/চিতার পাশে নিতুই এসে বিরাম নিও, প্রণাম নিও ঝরা বকুল ও দুটি পায়....” এই গান গাইতে। কিংবা এওতো গাইতে ইচ্ছে হবে-“  সেই চম্পা বকুল তলে তোমারে দেখেছি/ বন পথ চলিতে চলিতে/ ঝরা ফুল মঞ্জুরি তুলিতে আঁচলে... শুধু বকুল কলি আর চাঁপার কলি/ তুমি মোর কাছে দিয়ে গিয়েছো চলি...”। আর কৃষ্ণচূড়ার ডালে পাখি দেখলে তো মনে পড়বেই- “ কৃষ্ণচূড়ার রঙ লেগেছে প্রান্তরে নীল পাখিরা কাজ ভুলে তাই গান করে...” গানের কথা গুলি। আহা কত গানে ফুল আর পাখি আছে যেমন-“ কাননে কূহু ডাকা ফাগুণ সমীরে ভেঙোনা ভেঙোনা প্রিয় এ মধুরাতি” ; “ আমার পলাশ ডাল মহুয়ার নেশায় মাতাল পাখির গানে দোল যে ঝরেছে বুনো হাঁসের পাখায় দু’জন কোথায় ভেসে যাই” ; “ কি ব্যথা দোলায় সমীরণে পাখিরা যে তাই আনমনে উদাসী হ’য়ে যায়” ; “ যে পাখি হারায় নীড় সুদূর আকাশে সে কী কভু আশে ফিরে শিউলি ঝরানো আজি সন্ধ্যার বাতাসে” প্রভৃতি।

No comments:

Post a Comment