Saturday, 31 December 2016

সফিক আহমেদ

বন্ধুরা আজ আপনাদের কিংবদন্তি 'কথা সাহিত্যিক' হুমায়ুন আহমেদের বন্ধু সফিক আহমেদের কিছু কিছু কথা নিজের মতো করে বলার চেষ্টা করছি।গল্পটি পড়েছিলাম হুমায়ুন আহমেদ রচিত ''লীলাবর্তীর'' মৃত্যু উপন্যাসে।সপ্তম শতকের বিখ্যাত ভারতীয় গনিতঞ্জ শংকরাচার্যের একমাত্র মেয়ে ''লীলাবর্তী"।
বাবার সামর্থ্য ছিল না মেয়ের জন্য কিছু করার ।কিন্তু কথা দিয়ে গেয়েছিল এই বলে-"মাগো" তোমার জন্য কিছু করার সামর্থ্য নেই আমার,তবে পৃথিবীর মানুষ যেন তোমাকে মনে রাখে সেই ব্যবস্থা করে যাবো আমি।ঠিক তাই করেছিল লীলাবর্তীর বাবা তার নামে একখানা গনিতের বই লিখে।আজ তার মেয়ের নামে পাতায় পাতায় কিছু লেখার প্রচেষ্টায় ব্যকুল কবিগন।কেমন ছিল লীলাবর্তী ?সেই কল্পনায় করেন লেখনগন।হুমায়ুন আহমেদ তার কল্পনায় একদিন লীলাবর্তীকে স্বপ্নেও দেখেন।.........
.....................
বাদ দেন তার স্বপ্নের কথা ।কি জানি বলতে চাইছিলাম।ও হ্যাঁ-সফিক সাহেবের কথা।....হুম;
এই
সফিক সাহেব হলো লেখক হুমায়ুন আহমেদ সাহেবের কলেজ,ইউনিভার্সিটির খুব ভালো বন্ধু।অনেক দিন থেকে দেখা নাই।তবে লেখক হুমায়ুন সাহেবের কারো সাথে দেখা করার ইচ্ছাও ছিল না।দেখলেই সবাই বলতো কিরে বুড়ো তো হয়ে গেলি।
হা....হা।
তবে হুমায়ুন সাহেব মনে করতো যৌবন শরীরে নয়,মনে।তবু কার না চায় স্মার্ট হওয়ার।
একদা একদিন তিনি নাপিতের দোকান থেকে চুল কেটে বের হয়ে দেখলো চুলের গড়ায় সাদা দাগ।খুব বিশ্রী নাকি দেখাচ্ছে।মেজাজ তো খারাপ।তাই রাগে পান আর সিগারেট নিয়ে যেমনি দাঁড়ায়েছে তেমনি চেনা কিন্তু তবু অচেনা একজন ভদ্র লোককে দেখেতে পেল।সাথে একজন তরুনিও ছিল।ভদ্র লোকটি তাকে দেখেই চেচিয়ে বললো আরে তুই!!!!!!!!!
সে আর কেউ নয় তিনি হুমায়ুন সাহেবের বন্ধু সফিক সাহেব।মেয়েকে নিয়ে কোথায় জানি আসছিলো।যেমন ভাবা ঠিক তেমন কথা সফিক সাহেব তো বলেই ফেললো আগে: ছি! কি? বিশ্রী চুল কাটছিস তোকে একদম পকেটমারের মতো লাগছে। হা হা হা হা...... আজ আর তোকে ছাড়ছি না এই বলেই মেয়ে এক হাত আর সফিক সাহেব এক হাত ধরে তাকে জোর করে বাড়িতে নিয়ে গেল।সফিক সাহেব তার স্ত্রীকে অবাক করে দিল।কারন তার স্ত্রী হুমায়ুন সাহেবের খুব ভালো ভক্ত।একটিও নাটক বাদ যায় না দেখার। স্ত্রী ও ছেলে মেয়ে তাকে কাছে পেয়ে অনেক খুশি।কিন্তু বন্ধুর স্ত্রীকে দেখে তিনি খুব বিব্রত হলো।তার বুঝতে দেরী হলো না সেই হতভাগা নারী জীবন যুদ্ধে পরাজিত।ক্লান্তি ও হতাশা তাকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলছে।
মনের দুঃখে সফিক সাহেবের স্ত্রী শোনালেন আজ তার সংসারের অবস্থা যেন ভাঙ্গা নৌকার মতো!!!!!!!
সফিক সাহেব ব্যাংকের ম্যানেজার।অনেক বেতন হলেও কখনো তার স্ত্রীকে খুব বেশি টাকা হাতে দেন নি।সামান্য কিছু টাকা আর নিজের শিক্ষকতার টাকা দিয়েই ছেলে মেয়ের পড়াশুনা চালিয়ে নিয়েছে আবার সংসারের বোঝা।কষ্টের কথা বলতে বলতে চোখে জল ফেলিয়ে বললো,যাবার সময় বন্ধুকে একটু বুঝিয়ে যাবেন ।হুমায়ুন সাহেব কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না।অনেক দিন পর দেখা কিন্তু তাকে চোখের জল দেখতে হলো।তিনি বিষ্মিত হয়ে বন্ধুকে বললো:
কিরে সফিক সমস্যাটা কোথায় তোর?আরেকদিন বলবে বলে এড়িয়ে যেতেই জোর বায়না ধরলেন তিনি ।অবশেষে বলেই ফেলেন সত্য ঘটনা।
সফিক সাহেবের তখন বিয়ে হয় নি।ঠিক তখন মাঝে মাঝে এক দুই বার বন্ধুদের সাথে মদ্যপান সিলিব্রেট ,বেতন পেলেই বন্ধুর হুকুমে হুইষ্কির বোতল।আসলে সফিক সাহেব প্রায় মাতাল হয়েই বাড়ি ফিরতো।তবে খুব বেশি দিন এই মাতাল ছিল না।অবশেষে তিনি ভালো কাজে মাতাল হয়ে পড়ছিলেন।একদিন মদ্যপান করে মাতাল হয়ে বাসায় ফিরছিল রাস্তায় দেখলো এক বাবা তার ছেলেকে নিয়ে ভিক্ষে চাইছে ছেলের চিকিৎসার জন্য।
ছেলের হার্নিয়া!!!!এটা খুব খারাপ রোগ।সাত -আট বছরের ছেলে।নগ্ন অবস্থায় ভিক্ষা করে।না হয় তো কেউ অবিশ্বাস করে টাকাই দিবে না।এই দৃশ্য দেখেই মাতাল সফিক সাহেব একখানা ১০০ টাকার নোট বের করে দিল।এতে ছেলের বাবার মুখে মুচকি হাঁসি ফুটলো।তার আর বুঝতে দেরী হলো না যে, এই লোক ছেলের হয়তো চিকিৎসা করাবে না।ছেলেকে নিয়ে ভিক্ষা করাই তার পেশা।হয়তো কোন দিনও ছেলেকে হাসপাতালেও নেন নি।নেশাগ্রস্থ মাতাল যা ভাবে তাই করে,তিনি ছেলেকে সাথে সাথেই হাসপাতালে নিয়ে গেলেন।তার এক বন্ধু বড় ডাক্তার।সব কিছু খুলে বললেন।সব টাকাও সফিক সাহেব দিলেন।অপারেশন ডেট ঠিক হলো।অপারেশন হলো ।
কিন্তু এক ঘন্টা পর ছেলেটা মারা গেল।
হায়! হায় ! এ কী? সর্বনাশ!!!! ।
তার জন্য আজ ছেলেটা মারা গেল।ছেলের বাবা এখন কাকে নিয়ে বাঁচবে।তিনি ভয়ে আর লজ্জায় ছেলের বাবার সাথে দেখা না করেই বের হয়ে গেল হাসপাতাল থেকে।তিনি প্রতিঞ্জা করলেন আর পরোপকার করবেন না।যথেষ্ট শিক্ষা পেয়েছেন তিনি।সেদিন সারারাত তার ঘুম হলো না।
কেন ছেলেটা মারা গেল ?
কেন ? কেন???????........
সেই দিন থেকেই তার সমস্যা শুরু।তিনি ঠিক করলেন যখন যেখানে অসুস্হ ছেলেপেলে দেখবেন ,চিকিৎসা করাবেন।তিনি মাতাল হয়ে গেলেন।তিনি দেখতে চান এরা বাঁচে না মরে।সেই থেকেই শুরু রাস্তার
অসুখ বিসুখ কাতর কাউকে দেখলেই চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।টাকা পয়সা এতেই চলে যাইত তার।
তারপর করলেন আবার বিয়ে।বিয়ে যে কত মজা গো!!"যারা বিয়ে করছে তারাই ভালো বুঝেন এটা,,,বাদ দেন বিয়ের কথা,আগে বিয়ে করি তারপর বলবো নে!!!! হা হা।
ও তারপর তার একটা সংসার হলো।অন্য সব নেশা ছাড়তে পারলেও মানুষকে সাহায্য করা অভ্যাস আর গেল না।জীবনে অনেক রোগী সুস্থ করছেন তার বেতনের টকা দিয়ে।তাই তার স্ত্রীকে কখনো সম্পূর্ন টাকা দিতে পারেন নি তিনি।
তখন হুমায়ুন আহমেদ সাহেব বললো:- এখনো কি কারো চিকিৎসা চলছে??
উওরে সফিক সাহেব বলে, হ্যাঁ ---এখনো একজনের চিকিৎসা চলছে।জয়দেবপুরের এক মেয়ের।ঠোট কাটা,প্লাষ্টিক সার্জারি করে ঠোট ঠিক করা হবে।
তিনি মুগ্ধ গলায় চোখে জল ভরিয়ে বললেন--- দোস্ত তুই যে কত বড় কাজ করছিস সেটা কি তুই জানিস??????
রুমটা অনেক ক্ষুন শান্ত ছিল।
সফিক সাহেব অনেকক্ষূন পর চোখের জল সামলে নিয়ে বললো বড় কাজ হোক কিংবা ছোট কাজ হোক তবে দোস্ত কোন রোগী যেদিন সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে ,সেদিন আমার কত আনন্দ হয় তা শুধু আমিই জানি।এই আনন্দের কোন তুলনা নেই।প্রতিবারেই আমি আনন্দ সামলাতে না পেরে সবার সামনে হাউমাউ করে কেঁদে উঠি।
ধন্য সেই স্ত্রী সফিক সাহেবের মতো একজন স্বামী পেয়ে।কথা গুলো শুনে তার স্ত্রীর চোখে ছলনার এক অপরুপ মায়া লেগে ছিল।আনন্দ না ধরে রাখতে পেরে তিনি হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন।
আসলেই বন্ধুরা এই ক্ষমতা অল্প কিছু সৌভাগ্যবানের থাকে।সফিক সাহেব তাদের একজন।
স্যালুট সফিক স্যার।
প্রিয় পাঠক যারা আমার এই কষ্ট করে লেখাটা কষ্ট করে পড়লেন তাদের উদ্দেশ্যে একটা প্রশ্ন ?আমরা কি সৌভাগ্যবানের একজন হতে পারি না?? জানি সফিক স্যারের মতো হতে পারবো না কিন্তু যা পারি ?কি বন্ধুরা পারবো কি !
ধন্যবাদ।

No comments:

Post a Comment